আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা
তারিক মাহমুদুল ইসলাম
ষক রত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কৃষিমন্ত্রী জনাব ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এমপি এর তত্ত্বাবধায়নে ২০২১ এর বোরো মৌসুম থেকেই বাংলাদেশে নেওয়া হয় এক বিপ্লবী পরিকল্পনা যন্ত্রায়ন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, যা বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষির ভিত্তিস্থাপন করে। ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার এই প্রকল্প আনুষ্ঠানিক ৩ বছর পার করছে জুন ২০২৩। যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের কৃষির কার্যক্রম সম্পাদন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার অন্যতম। এরই মধ্যে গত আমন ও বোরো মৌসুমে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে কম্বাইন হারভেস্টর। কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকের প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। প্রকল্পে ডিপিপিতে বলা হয়েছে ৫ বছরে অর্থ ২০% সাশ্রয়, সময় ৫০%। প্রকল্প ইতিমধ্যেই ৮০% অর্থ সাশ্রয়, ১৫০% সময় সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে গত তিন বছরে কৃষকের মাঝে ৯,০০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা সমস্ত প্রক্রিয়া (ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী) করে কৃষক বাজারে ধান বিক্রয় করতে সক্ষম হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় দেখা যায় এক সাথে ধান সিদ্ধ করা হচ্ছে। সাশ্রয়কৃত সময় কৃষকরা শিল্প কারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নত ও শিল্প সমৃদ্ধের দেশ গড়ে তুলছে। কম্বাইন হারভেস্টারসহ কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ঘিরে সারা দেশে খুচরা যন্ত্রাংশের বিশাল বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। যা গ্রামীণ অর্থনৈতিকে এক অন্যূন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
কম্বাইন হারভেস্টারের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনের দেশ হবে বাংলাদেশ। প্রদিবেদনে উল্লেখ করা হয় চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন ধানের জাতসহ যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী জনাব ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি জানান ধান কাটার ক্ষেত্রে সরকার যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর ফলে এমন সফলতা।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো ৪%। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দাড়িয়েছে আমন মৌসুমে ১১.২২% বোরো মৌসুমে ২২.১৭%। গড়ে ১৬.৬%। কিছু দিন আগেও এ আধুনিক যন্ত্র সম্পর্কে অনেকের ধারণা ছিল না। ছিল সংশয় ও ভীতি। বর্তমানে সে অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসেছে কৃষক।
ইতিহাস বলছে ষাটের দশক থেকে এ দেশে পাওয়ার টিলার, সেচ মেশিন কাজ শুরু করেছে। এই মেশিনগুলো ৯০ এর দশকে এসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একটি প্রযুক্তি চালু করে কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা করতে ৩০ বছর সময় লেগেছে। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে জটিল আধুনিক মেশিন কম্বাইন্ড হারভেস্টার মাত্র ৩-৪ বছরে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ডিএইর এক জরিপে পর্যালোচনা করে দেখা যায় সনাতন পদ্ধতিতে ১ একর ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী করতে শ্রমিকের সময় লাগে (১৮ জন, ৮ ঘণ্টা হিসাবে) ১৪৪ ঘণ্টা। অর্থের হিসাবে ১৪,৪০০ টাকা। সাথে কৃষক-কৃষাণির পরিশ্রম। কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে পরিশ্রম ছাড়া সকল কাজ মাত্র ১ ঘণ্টা সম্ভব। খরচ পড়ে ৬,০০০ টাকা।
বাংলাদেশের হাওর এলাকা আমন ও বোরো মৌসুমে ৩৮০০টি কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে মোট জমি ৭০% ধান কাটা হয়। ধান কাটার জন্য বন্ধ করে দেয়া হতো স্থানীয় বালু মহলগুলো। তবে এ বছরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। হাওরে তেমন কোনো শ্রমিক সংকট ছিল না।
কম্বাইন হারভেস্টার আমন ও বোরো মৌসুমে কর্তনকৃত জমির পরিমাণ ১৭,৪২,০৩৮ হে.। আমন ও বোরো মৌসুমে শস্যের অপচয় রোধ ৪,১৩,৭১৬ টন যার বাজারমূল্য প্রায় ১০১৮ কোটি। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা আমন ও বোরো মৌসুমে ধান কর্তনে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ১,৬৯৫ কোটি। মোট সাশ্রয়ের পরিমান ২,৭১৪ কোটি টাকা।
২০২২-২০২৩ অর্থবছর ঘূর্ণিঝড় মোখার ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় কম্বাইন হারভেসটার সারা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঐ সময় কৃষকের খেতে পাকা ধান ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ও শ্রমিক সংকটের মধ্যেমে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কেটে, মাড়াই ও ঝাড়াই করে কৃষকের ঘরে ধান তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে সন্তষ্টি প্রকাশ করেছে কৃষক।
যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং একটি ফসল থেকে আর একটি ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে ১টি ফসলের স্থানে ২টি ফসল, ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। কম্বাইন হারভেস্টার কৃষিতে যে অবদান রাখছে তার একটি সঠিক গবেষণা চালিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে দেখা যাবে কম্বাইন হারভেস্টার কৃষিতে জাদুকরী পরিবর্তন এনেছে। কম্বাইন হারভেস্টার শুধু যে ধান কাটার মাঝে সীমাবদ্ধ তাই নয়। এখন গম, সরিষা মাড়াই কাজও ব্যবহার হচ্ছে।
বাড়ছে ফলন, কমছে উৎপাদন খরচ, কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ঘটছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সহায়তা করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি, কৃষক, কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য অংশীজনের সহায়তায়, প্রকল্পটি বাংলাদেশের কৃষির আদল পরিবর্তনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। সর্বোপরি কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করছে।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, মোবাইল : ০১৭১৮১১৪৪৮০ ই-মেইল : mechanizafiondae@gmail.com